ভালোবাসার মহাকাব্য ভালো ৫ টি জীবনানন্দ দাশের কবিতা

akhi akter

জীবনান্দ দাশ, বাংলা সাহিত্যের অবিস্মরণীয় এক অধ্যাপক, প্রতিভাবান কবি এবং লেখক ছিলেন। তার জন্ম ১৮৯৯ সালে হয়েছিল বাংলার বারিশালে। তিনি ছিলেন একজন অত্যন্ত শিক্ষাবিদ ও দীর্ঘস্থায়ী সাহিত্যিক, যার কবিতা ও গল্পে সাহিত্যের প্রাসাদিক মূলত বর্ণিত হয়।

জীবনান্দ দাশের কবিতা ছড়িয়ে দেয় ভাবনার নিউয়ান্স এবং মানব অসীম অনুভূতির ভাবনা। তার কবিতার মাধ্যমে প্রকাশ পায় মানুষের জীবনের আন্তর্দৃষ্টি, সহজগামী উপাত্ত, এবং ভাবনার অগোচর আলোক।

তার শিক্ষার্থী জীবনানন্দ দাশের সাহিত্যিক ক্ষেত্রে অসীম প্রতিভার প্রকাশ পায়। তিনি সাহিত্যের প্রতিটি বিভাগে অগ্রগতি করেন, যাতে তার রচনার বিভিন্ন সুর প্রকাশ পায়। জীবনান্দ দাশের কবিতা ও গল্পের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে মানুষের ভাবনা ও সমাজের প্রতি তার সত্যের প্রেম।

তার শেষ দিনগুলি পাশের মানুষের মাঝে দুঃখ ও বিচ্ছিন্নতা ছড়িয়ে দিয়েছিল, তার সাহিত্যিক কর্মক্ষেত্রে এক অমূল্য অবদান প্রদান করে নিজেকে স্থায়ী করে রেখেছে।

আকাশলীনা 

(জীবনানন্দ দাশ – সাতটি তারার তিমির) 

সুরঞ্জনা, ঐখানে যেয়োনাকো তুমি,

বোলোনাকো কথা অই যুবকের সাথে;

ফিরে এসো সুরঞ্জনা:

নক্ষত্রের রুপালি আগুন ভরা রাতে;

ফিরে এসো এই মাঠে, ঢেউয়ে;

ফিরে এসো হৃদয়ে আমার;

দূর থেকে দূরে – আরও দূরে

যুবকের সাথে তুমি যেয়োনাকো আর।

কী কথা তাহার সাথে? – তার সাথে!

আকাশের আড়ালে আকাশে

মৃত্তিকার মতো তুমি আজ:

তার প্রেম ঘাস হয়ে আসে।

সুরঞ্জনা,

তোমার হৃদয় আজ ঘাস :

বাতাসের ওপারে বাতাস –

আকাশের ওপারে আকাশ। 


শঙ্খমালা 

(জীবনানন্দ দাশ – বনলতা সেন) 

কান্তারের পথ ছেড়ে সন্ধ্যার আঁধারে

সে কে এক নারী এসে ডাকিল আমারে,

বলিল, তোমারে চাই:

বেতের ফলের মতো নীলাভ ব্যথিত তোমার দুই চোখ

খুঁজেছি নক্ষত্রে আমি- কুয়াশার পাখনায়- 

সন্ধ্যার নদীর জলে নামে যে আলোক

জোনাকির দেহ হতে-খুজেছি তোমারে সেইখানে-

ধূসর পেচার মতো ডানা মেলে অঘ্রাণের অন্ধকারে

ধানসিড়ি বেয়ে-বেয়ে

সোনার সিঁড়ির মতো ধানে আর ধানে

তোমারে খুঁজছি আমি নির্জন পেঁচার মতো প্রাণে।

দেখিলাম দেহ তার বিমর্ষ পাখির রঙে ভরা;

সন্ধ্যার আঁধারে ভিজে শিরীষের ডালে যেই পাখি দেয় ধরা-

বাঁকা চাঁদ থাকে যার মাথার উপর,

শিঙের মতন বাঁকা নীল চাঁদ শোনে যার স্বর।

কড়ির মতন সাদা মুখ তার;

দুইখানা হাত তার হিম;

চোখে তার হিজল কাঠের রক্তিম

চিতা জ্বলে: দক্ষিণ শিয়রে মাথা 

শঙ্খমালা যেন পুড়ে যায় সে আগুনে হায়।

চোখে তার যেন শত শতাব্দীর নীল অন্ধকার!

স্তন তার করুণ শঙ্খের মতো – 

দুধে আর্দ্র-কবেকার শঙ্খিনীমালার!

এ পৃথিবী একবার পায় তারে, পায় নাকো আর।


বনলতা সেন 

(জীবনানন্দ দাশ – বনলতা সেন)

হাজার বছর ধরে আমি পথ 

হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,

সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের 

অন্ধকারে মালয় সাগরে

অনেক ঘুরেছি আমি; 

বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে

সেখানে ছিলাম আমি; 

আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;

আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, 

চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,

আমারে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিলো 

নাটোরের বনলতা সেন।

চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,

মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; 

অতিদূর সমুদ্রের ’পর

হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা

সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে 

চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,

তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে , 

‘এতোদিন কোথায় ছিলেন?’

পাখির নীড়ের মত চোখ 

তুলে নাটোরের বনলতা সেন।

সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন

সন্ধ্যা আসে; 

ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;

পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে 

পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন

তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল;

সব পাখি ঘরে আসে — 

সব নদী- ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন;

থাকে শুধু অন্ধকার, 

মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন। 


অদ্ভত আঁধার এক

(জীবনানন্দ দাশ) 

অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ,

যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দ্যাখে তারা;

যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই – 

প্রীতি নেই – করুণার আলোড়ন নেই

পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।

যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি

এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক ব’লে মনে হয়

মহত্‍‌ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা

শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়। 


কুড়ি বছর পরে

(জীবনানন্দ দাশ – বনলতা সেন)

আবার বছর কুড়ি পরে তার সাথে দেখা হয় যদি!

আবার বছর কুড়ি পরে-

হয়তো ধানের ছড়ার পাশে

কার্তিকের মাসে-

তখন সন্ধ্যার কাক ঘরে ফেরে-তখন হলুদ নদী

নরম নরম হয় শর কাশ হোগলায়-মাঠের ভিতরে!

অথবা নাইকো ধান ক্ষেতে আর,

ব্যস্ততা নাইকো আর,

হাঁসের নীড়ের থেকে খড়

পাখির নীড়ের থেকে খড়

ছড়াতেছে; মনিয়ার ঘরে রাত, 

শীত আর শিশিরের জল!

জীবন গিয়েছে চলে আমাদের 

কুড়ি কুড়ি বছরের পার-

তখন হঠাৎ যদি মেঠো পথে পাই 

আমি তোমারে আবার!

হয়তো এসেছে চাঁদ মাঝরাতে 

একরাশ পাতার পিছনে

সরু সরু কালো কালো 

ডালপালা মুখে নিয়ে তার,

শিরীষের অথবা জামের,

ঝাউয়ের-আমের;

কুড়ি বছরের পরে তখন তোমারে নাই মনে!

জীবন গিয়েছে চলে আমাদের 

কুড়ি কুড়ি বছরের পার-

তখন আবার যদি দেখা হয় তোমার আমার!

তখন হয়তো মাঠে হামাগুড়ি দিয়ে পেঁচা নামে

 বাবলার গলির অন্ধকারে

 অশথের জানালার ফাঁকে

 কোথায় লুকায় আপনাকে!

চোখের পাতার মতো নেমে চুপি চিলের ডানা থামে-

সোনালি সোনালি চিল-শিশির 

শিকার করে নিয়ে গেছে তারে-

কুড়ি বছরের পরে সেই 

কুয়াশায় পাই যদি হঠাৎ তোমারে!  

Leave a comment