নয়নে বাঁধিব তোমায় আমার প্রেমের অভিনয়

akhi akter

নয়নে বাঁধিব তোমায় আমার প্রেমের অভিনয়

কলুষিত মনের অধিকারী মানুষের মন পরিষ্কার হয় না তবে কখনো তাদের মনের রং পরিবর্তন হয়ে যায়। বিগত দুই সপ্তাহ নয়নার সারাদিন কেটেছে বদ্ধঘরে। একজন পাগলকে যেমন আটকে রাখা হয়, নয়নাকেও তেমন আটকে রাখা হয়েছিল; পার্থক্য ছিল শুধু একটি শিকলের।

আকলিমা তিনবেলার খাবার শুধু দিয়ে যেতো। নয়না ইচ্ছে হলে খেতো, আবার ইচ্ছে হলে রেখে দিতো। জানালার ধারে বসে আকাশের বুকে পাখিদের ডানামেলে উড়ে যাওয়া দেখতো। কতোবার আত্মহত্যার চিন্তা সে করেছে হিসাব নেই। চলন্ত পাখার দিকে তাকিয়ে মনে হাজারো কল্পনা ঝল্পনা আঁকতো সে। এতো সহজেই কী আত্মহত্যা করা যায়! আত্মহত্যার পথ মন্দ কথাটা স্মরণে আসতেই ডুকরে কেঁদে উঠতো নয়না। সে ভেবেছিল এভাবেই তাকে বন্দিনী অবস্থায় জনম পাড় করতে হবে। কিন্তু তার ধারণা ভুল, গতকাল রাতেই আকলিমা তাকে মুক্ত করে দিলো। নয়নার দিকে নতুন এক সেট কাপড় ছুড়ে দিয়ে বলল,” আগামীকাল সকালে তৈরী হয়ে থাকবি। তোকে দেখতে আসবে।”

বাশারের কাছে সম্মান হারানোর থেকে পরের ঘরে পড়ে থাকাই উত্তম মনে হলো নয়নার। তবে মনের এক কোণে পড়ে থাকা তূর্যের প্রতিচ্ছবির কথা ভেবে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে নয়না। ভাগ্য তার এমনিতেও খেলা করছে। মেয়েদের জীবনে চাহিদার কমতি নেই অথচ নয়নার একটাই চাহিদা আর সেটা হলো সুখ! সুখ আদৌও কী নয়নার ভাগ্যে আছে?

নয়নার ফুফা চা-খোর। ভদ্রলোকের নাম বোরহান উদ্দিন। আকলিমা অজানা কোনো এক কারণে স্বামীকে দেখতে পারেন না। দুরুত্ব বজায় রাখেন সর্বদা। তাতে ভদ্রলকের মাথা ব্যাথা নেই। তিনি নিজের জীবন নিয়ে দিব্যি সুখে আছেন। তবে নয়নার কেন যেন মনে হয়, তার মায়ের কারণে আকলিমার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ কিছু হারিয়েছে; যার কারণে আকলিমা নয়নাকে সহ্য করতে পরে না।

ফুফার জন্য নয়না কড়া লিকারের চা করে আনলো। চায়ের কাপে ছোট্ট চুমুক দিয়ে চোখ বন্ধ করে নিলো বোরহান উদ্দিন। অনিমেষ চেয়ে রইলো নয়নার দিকে। তখনই নয়নার ঠোঁটের কোণে কালো দাগ দেখে বুঝতে বাকী রইলো না তার অবর্তমানে নয়নার সাথে কী কী ঘটে। বোরহান উদ্দিন তপ্ত নিশ্বাস ত্যাগ করে বলল,” তোর ফুফু এখনো তোকে মা’রে?”
নয়না মিথ্যা বলল,” না, ফুফা।”

নয়নে বাঁধিব তোমায় আমার প্রেমের অভিনয়

” তাহলে তোর হাতে, মুখে কালসিটে দাগগুলোর কীসের?”
নয়না হাতের দাগগুলো ওড়নার আড়ালে লুকানোর বৃথা চেষ্টা করে বলল,” বাথরুমে পা পিছলে পড়ে গিয়েছিলাম, চা কেমন হয়েছে ফুফা?”

বোরহান উদ্দিন বুঝতে পারলেন নয়না কথা ঘোরাতে চেষ্টা করছে। তিনি উদাস হয়ে চায়ের কাপে চুমুক বসান।

সকালবেলায় বোরহানকে দেখতে পেয়ে বাশার অবাক হয়ে গেলো, মুখে প্রকাশিত হল বিরক্তির ছাপ! বাবার কাছে এসে পায়ে ধরে সালাম করলো সে। ভদ্রতার খাতিরে বলল,” আমাকে খবর দিতেন,আব্বা। বাস স্ট্যান্ড থেকে নিয়ে আসতাম!”
বোরহান উদ্দিন ছেলের কদমবুসিতে প্রফুল্লচিত্তে বললেন,” সারারাত পড়াশোনা করেছিস, তাই বলিনি। কেমন আছিস,বাবা?”

” ভালো আছি। আপনার শরীর ভালো তো আব্বা?
বোরহান উদ্দিনের উত্তরের অপেক্ষা করলো না বাশার, উচ্চ স্বরে নয়নাকে ডেকে বলল,” বাবাকে চা দিয়েছিস,নয়না?”

‘মুখে মধু, অন্তরে বিষ’ কথাটার সাথে বাশারের চরিত্র যায়। বোরহান উদ্দিনের সামনে বোনের মতো আচরণ করছে অথচ নয়নার সামনে রক্ষিতার মতো আচরণ করে। নয়নার ক্ষমতা থাকলে বাশারের জিভ কে’টে নিতো। পশ্চাৎদেশে একশো বেত্রাঘাত করে উলঙ্গ অবস্থায় ছেড়েও দিতো। তখন বাশার বুঝতো একজন নারীর কাছে তার সম্মান ঠিক কেমন।

নয়নার উত্তর না পেয়ে বাশার অপমানিতনোধ করলো। বাবার সামনে দাঁতে দাঁত চেপে আগের চেয়ে নরম স্বরে ডাকলো,” নয়না, বোন আমার! খুব ক্ষুধা পেয়েছে। সকালের নাশতায় কী বানালি?”
এতো মধু! নয়নার শরীর জ্বলছে, রাগে ঠোঁট তিরতির করে কাঁপছে। রান্নাঘর থেকেই উত্তর দিল, ” পরোটা, ডাল, ভাজি।”

” আহ! নয়না যা নাশতা বানায় বাবা! বড়ো বড়ো রেস্টুরেন্টও হার মানাবে, আমার তো সবসময় ওর রান্না পছন্দ। মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয়, ঐ হাতজোড়া খুঁটিয়ে দেখতে। কিন্তু ছোট বোন লজ্জা পাবে তাই দেখি না।”
বাশার কথার সারমর্ম বোরহান উদ্দিন না বুঝলেও নয়না ঠিকই বুঝে। ঘৃণায় এক দলা থুতু ফেলে ডাস্টবিনে।

দুপুরে নয়নাকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসে। বাশার বাড়ির বাহিরে ছিল, সে নয়নাকে দেখতে আসার ব্যাপারে অজ্ঞ ছিল। পাত্রপক্ষ হচ্ছে সেইদিনের হ্যাংলা পাতলা নুমান। বাশারের বন্ধু। বাবা-মাকে নিয়ে আঁটসাঁট বেঁধে আকলিমার দুয়ারে এসেছে। বোরহান উদ্দিন বাড়ি এসেই এমন পরিস্থিতির শিকার হবেন ভাবতেই পারেননি। সম্মানার্থে অতিথিদের সাথে খোশগল্প করছেন হাসিমুখেই। আকলিমা পারছে না, আজই নয়নাকে নুমানের ঘাড়ে তুলে দিতে। পাত্র কে সেই ব্যপারে নয়নাও জানে না। ঘরে এসে জানালার দিকে নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। তার দীর্ঘশ্বাসে একরাশ অভিমান! তার জীবনে কেউ টিকে থাকলো না। বাবা-মা, ভাই-বোন, বন্ধু আর তূর্য! তূর্যের কথা ভাবনায় আসতেই নয়না পড়ার টেবিলের পাশে যত্নে রাখা শাপলার মালার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো। তার আত্মা, তার মন কোনোটাই ঠিক নেই। কেউ যেন চুরি করে নিয়ে গেছে।

আকলিমা নয়নার ঘরে এসে দেখেন সকালের কাপড় এখনো নয়নার গায়ে। একপ্রকার বিরক্ত হয়ে তিনি বললেন,” ঢং বাদ দিয়ে তৈরী হয়ে বাহিরে আয়। মেহমান চলে এসেছে।”

কথাটা বলে আকলিমা চলে যেতে নিয়ে পুনরায় ফিরে আসলো। নয়নার দিকে গাঢ় চোখে তাকিয়ে বলল, ” হাতে, মুখে পাওডার মেখে নিস। দাগগুলো বুঝা যাচ্ছে।”

আকলিমা চলে যেতেই নয়না তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে। গায়ের জামা পরিবর্তন করে হাতে ও মুখে পাওডার মেখে নেয় সে। সাজগোজ তার কোনোকালেই পছন্দ না। মাথায় লম্বা ঘোমটা টেনে ঘর থেকে বের হয়ে যায় সে।

নয়নাকে আকলিমা ধরে পাত্রপক্ষের সামনে বসিয়ে দিলো। নয়না চোখ তুলে তাকাচ্ছে না। আকলিমাই কথাবার্তা শুরু করলো,” নয়না, আমার ভাইজি। যেমন সুন্দরী তেমন কাজেও পটু। বিয়ের পর আপনাদের কোনো কাজই করতে হবে না। লাখে এক আমার ভাইজি।”

নুমান লজ্জা পাচ্ছে। অমন সুন্দরী বউ তার হবে ভেবেই শরীরে শীতল হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। নুমানের মা মুখ খুলল,” আমার নুমানও লাখে এক। সারাদিন বাবার সাথে দোকানে বসে, কোনো মেয়ের দিকে তাকিয়ে দেখেই না। বাজে কোনো নেশা নেই।”

আকলিমা মনে মনে ভেংচি কাটেন। এই ছেলেকে দুইদিন আগেও বাজারে সিগারেট খেতে দেখেছে সে। এদিকে তার মা বলছে কী? যাই বলুক না কেন? আকলিমার এতে কিছু যায় আসে না। সে এই মেয়েকে বিদায় করতে পারলেই বাঁচে।
” নয়নার সাথে আমি আলাদাভাবে কথা বলতে চাই,আন্টি।”

পরিচিত কন্ঠস্বর শুনতে মেয়ে নয়না চোখ তুলে তাকালো। বাশারও ঠিক সেই সময়ে বাড়িতে প্রবেশ করলো।নুমানকে দেখে বলল,” এখানে কী করছিস?”
নুমান আমতাআমতা করে উত্তরে বলল,” মেয়ে দেখতে এসেছি।”

বাশারের অগ্নিসংযোগে এক ফোঁটা ঘি ঢালার জন্য নুমানের কথাই যথেষ্ট ছিল। সে সকলের সামনে নুমানের কলার চেপে ধরে বলল,” সারারাত গাঞ্জা টাইনা দিনে মুসল্লি সাজতে আসছিস? বের হো আমার বাড়ি থেকে।”

আকলিমা হতভম্ব। বাশার নুমানকে পশ্চাৎদেশে লাথি মেরে বাড়ি থেকে বের করে দিলো। নুমানের বাবা-মা ছেলেকে অপমানিত হতে দেখে নাকমুখ কোঁচকান। যাওয়ার আগে আকলিমার উদ্দেশে বলেন, ” ঘরে অবিবাহিত ছেলে মেয়ে রেখে ফষ্টিনষ্টি করান, আর লোকসমাজের সামনে ভাল সাজান? আপনার মুখোশ যদি টেনে না খুলছি তো আমি নুমানের মা না।
” তোরে যদি দ্বিতীয়বার এদিকে দেখি,তো জানে মেরে ফেলবো।”
আকলিমা রাগান্বিত হয়ে ছেলের গালে পরপর থাপ্পড় বসান। বোরহান উদ্দিন আকলিমাকে ধমক দেন সাথে সাথে, ” ওকে মারছো কেন?”

আকলিমা নিরুত্তর। সে যা বুঝার বুঝে গেলো। নয়নার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,” আমার ছেলের মাথা খেয়েই ছাড়লি, মা’গী।”

বাশার রাগে কাঁপছে। নয়নাকে পাওয়ার তীব্র আকাঙ্খা আজ আরো গাঢ় হলো। বাশার জানে, আকলিমা নয়নাকে আজকের পর থেকে যেভাবেই হোক বাড়ি ছাড়া করবে। কিন্তু নয়নাকে তার চাই-ই চাই। এর জন্য যদি তার বাবা মায়ের কাছে খারাপ হতে হয় তাই করবে। এখন শুধু রাতের অপেক্ষা!

Leave a comment