তুমি বলো আমি কত সেকেন্ড লেট করে এসেছি

akhi akter
তুমি-বলো-আমি-কত-সেকেন্ড-লেট-করে-এসেছি

তুমি বলো আমি কত সেকেন্ড লেট করে এসেছি

সকাল ১০টা। কফির মগে চুমুক দিতে দিতে নিজের কেবিনে বসে ফাইল চেইক করছে মেহরিন। হঠাৎ একটা ফাইলে চোখ আঁটকে গেলো, ভ্রুকুটি একত্রিত করে সম্মুখে তাকালো। অভিব্যক্তি তার নিত্যদিনের মত নিষ্প্রভ, শ্রান্ত। মেহরিন বিরক্তকর কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলো,
“এই ফাইলটা কে রেডি করেছে? মনে হয় নে’শা করে কাজ করেছে। এত ভু’লে ভরা? এটা ঠিক করতে আমার দ্বিগুণ শ্রম লাগবে। তাকে ডাকো এক্ষুণি!”

তুরফা নতদৃষ্টিতে হালকা ঢোক গিললো। মেহরিন ওকে আমতা আমতা করতে দেখে ভ্রু উঁচিয়ে বোঝালো, “কি?”
তুরফা জো’রপূর্বক ঠোঁট প্রসারিত করলো। মেহরিন যা বোঝার বুঝে গিয়েছে। ক্ষণেই ওর ফর্সা চেহারায় হালকা রা’গ ফুটে উঠলো। জো’রে শ্বাস ছেড়ে রয়েসয়ে বললো, “সানি আর আলিফকে আমার রুমে আসতে বলো। মি. রহমান তো ছুটিতে আছেন, কবে ফিরবেন?”
“এই তো ম্যাম দুদিন পরে।”
“ওহ!” আলগোছে কথাটা বলেই চোখ দিয়ে ইশারায় তুরফাকে চলে যেতে বললো। ও যেতেই মেহরিন হাত থেকে কলমটা রাখলো। আলতোভাবে কফিতে চুমুক দিতে দিতে কি যেন ভাবতে লাগলো।

সকাল ১১ টা ছুঁই ছুঁই। এক হাত পকেটে, আরেক হাতে চশমা ঘোরাতে ঘোরাতে হেলেদুলে অফিসে প্রবেশ করলো তাজওয়ার। ওকে দেখে মনে হচ্ছে ও বন্ধুদের সাথে ঘুরতে যাচ্ছে। চেহারায় কোনো চিন্তার লেশ নেই। আলিয়া ওকে অবলোকন করা মাত্রই দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে বললো, “স্যার! অফিস শুরু ১০ টায়। আপনি আজও লেট করে আসছেন।”

কথাটা কর্ণকুহরে ত্বরান্বিত হতেই তাজওয়ার থামলো, ঘাড় বাকিয়ে আলিয়ার দিকে তাকিয়ে চোখে মুখে কিছু টা সিরিয়াস ভাব ফুটিয়ে বললো, “ওহ নো! দেরি করে ফেলেছি না? সো সরি! কাল থেকে আরও পরে আসবো।”

কথাটা বলেই শব্দ করে হেসে উঠলো তাজওয়ার।আলিয়া অবাক চোখে তাকালো। ও ভাবলো কি? আর হলো কি? সিরিয়াস ভাব দেখে তো ভেবেছিলো ভালো হয়ে গেছে।

“আমাকে সময় শিখাচ্ছো? আমি যখন আসবো তখনেই অফিসের টাইম। বুঝেছ? আমাকে শেখানোর তুমি কে? যেখানে আমার বাবাই আমাকে শিখাতে পারলো না। আচ্ছা! তুমি বলো আমি কত সেকেন্ড লেট করে এসেছি?”

কথাগুলো বলতে বলতে পাশ থেকে একটা চেয়ার টেনে পায়ের উপর পা তুলে বসলো তাজওয়ার। নতমস্তকে দাড়িয়ে আলিয়া আমতা আমতা করতে লাগলো। কি বলবে? কতক্ষণ ধরে গুনবে? ওর উত্তর পছন্দ না হলে শাস্তি দিতেও পারে। ওর কাজেই শুধু মানুষকে উল্টোপাল্টা কথা বলে চিন্তায় ফেলে দেওয়া আর মজা দেখা। আলিয়ার প্রত্যুত্তরের জন্য তাজওয়ার অপেক্ষা করলো না। নৈঃশব্দ্যকে বিদায় হাতে থাকা চশমাটা চোখে দিয়ে বললো, “বাই দ্যা ওয়ে! আমাকে কেমন লাগছে বলোতো?”

তুমি বলো আমি কত সেকেন্ড লেট করে এসেছি
তুমি-বলো-আমি-কত-সেকেন্ড-লেট-করে-এসেছি

আলিয়া চোখ বড় তাকালো। কিসের মধ্যে কি টেনে নিয়ে আসছে? সব সময় উল্টা পাল্টা বিষয় নিয়ে থাকে। কোনো কাজে মন নেই। কি আর করবে ও জো’রপূর্বক হেসে কিছু বলতে যাবে তার আগেই পিছন থেকে একজন বলে উঠলো।

“হিরো আলম চোখে চশমা দিলে যেমন লাগে তার থেকে বেশি ভালো লাগছে না। তাইনা আলিয়া?”

সহসা অতি পরিচিত, রিনরিনে কণ্ঠ কর্ণকুহরে ত্বরান্বিত হতেই তাজওয়ার ঘাড় কাত করে আলিয়ার পাশ দিয়ে সোজা পিছনে তাকালো। মেহরিন বুকে হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে আছে। চোখে-মুখে রা’গ স্পষ্ট। ওকে দেখে অতি দ্রুত তাজওয়ার চেয়ার থেকে দাড়িয়ে গেলো, জো’রপূ’র্বক হেসে বিনম্র ভাব ফুটিয়ে বললো, “আরে বস আপনি? আপনি কষ্ট করে আসতে গেলেন কেনো? আমাকে ডাকলে তো আমিই চলে যেতাম।”

“ওহ তাই বুঝি? তোমাকে ডেকে পাই আমি? বাই দ্যা ওয়ে পেয়েছো তোমার উত্তর? এবার কাজে মন দাও!”

কথাটা শুনে তাজওয়ার চোখ ছোট ছোট করে মেহরিনের দিকে তাকালো। ওর কথাটা মোটেও বিশ্বাস যোগ্য হওয়ার পর্যায় পরলো না। ক্ষণেই তাজওয়ার কিছুটা ভাব নিয়ে বলে উঠলো, “আমাকে মোটেও ওমন লাগে না। সব মেয়েরা বলে আমি খুব সুন্দর, স্মার্ট। আপনার তো ব্লাইন্ড চোখ। আমার সৌন্দর্য দেখবেন কি করে? চশমা ইউজ করেন।”

“জাস্ট সাট-আপ!”
মেহরিনের ধমকে তাজওয়ারের তেমন ভাবাবেগ হলো না। ও কাওকেই ভয় পায় না। বলতে গেলে কারো কথাতেই ও গুরুত্ব দেয় না। নিজেকে ছাড়া কাউকেই গুরুত্ব দেয় না। কাজের প্রতি হেঁয়ালি মেহরিন একেবারেই পছন্দ করে না। কিছুটা রূ’ষ্ট কণ্ঠে বললো, “এক্ষুণি আমার কেবিনে আসো!”

কথাটা বলতে বলতে মেহরিন চলে গেলো। তাজওয়ার ফুস করে জো’রে শ্বাস ছেড়ে চেয়ারে বসে পরলো। এতক্ষণে ও স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়লো। এই মেয়েটা ওকে প্যারা দিতেই থাকে। কেনো যে এত কাজ নিয়ে থাকে! মাঝে মাঝে একটু হাসলেও তো পারে। ও আলিয়ার দিকে তাকিয়ে ক্লান্ত ভঙ্গিতে বললো, “যাও! আমার জন্য এক গ্লাস ঠান্ডা জল নিয়ে এসো!”

আলিয়া বড় বড় চোখ করে তাকালো। ও বুঝেনা এই লোকটা কি? কোনো কিছুকেই গুরুত্ব দেয় না। কি বলে গেলো মনেই নেই। ও হালকা হেসে স্মরণ করালো, “স্যার! ম্যাম ডেকে গেলো তো!”
“উফফ! রাখো তোমার ম্যাম! এই অফিসে আমি কারো কথা শোনার মানুষ নই। গট ইট?”
আলিয়া জো’রপূর্বক হাসলো।

“আলিয়া বাইরে যাও!” ফের মেহরিনের কণ্ঠস্বর শুনে তাজওয়ার ভরকে গেলো। বস না চলে গেলো? আবার আসলো কেনো? মেহরিন আলিয়ার দিকে তাকিয়ে শান্ত স্বরে বললো।

“গিয়ে নিজের কাজ করো। সানি আর তুমি স্মৃতির খবর নেও। ওর বাড়ি কোথায়? কার সাথে মিশতো৷ ওর বিষয়ে সব কিছু জেনে এসো। অফিসে আমি, আলিফ, তুরফা তো আছি। এখানে তুমি কারও কাজ করার গোলাম নও যে তার হুকুম মানবে।”

“ম্যাম আমি না এই মেয়েটার কিছুই বুঝতে পারছি না, বাড়ি কোথায় তাও কেউ জানে না, না এই শহরে কোনো আত্মীয় আছে, তো আসলো কার কাছে?”
ভাবুক হয়ে কথাটা বললো আলিয়া। তাজওয়ার হাসতে হাসতে বলে উঠলো।

“আরে না বোঝার কি আছে? প্রেমিকের সাথে পালিয়ে এসেছে, প্রেমিক ফেলে চলে গেছে তারপর আত্মহত্যা…
কথাগুলো কর্ণরন্ধ্রে আলোড়ন তুলতেই মেহরিন থমকালো। নিগূঢ় স্তিমিত অক্ষিকোটর কিন্তু রোষাগ্নি চাহনিতে কথা শেষ হওয়ার আগেই তাজওয়ারের দিকে তাকিয়ে বর্জ্রঝরা কণ্ঠে উঠলো।

“মেয়েরা শুধু ভয়ে নিজেকে গুটিয়েই নেয় না, প্রয়োজন হলে সকল পাপকে গুটিয়েও দিতে জানে। মেয়েদের দূর্বল ভেবে ভুল করো না, দেখা যাবে একদিন একটা মেয়েই তোমাকে শেষ করে দিলো।”
“সব মেয়েরা তো আপনার মতো নয় বস! আর আমায় শেষ করা অত সহজ নয়। মেয়ে তো কখনই না!”

তাজওয়ার বেশ ভাব নিয়ে কথাগুলো শেষ করলো। মেহরিনের রাগ এখনও কমেনি। তবুও ওর কথাকে পাত্তা দিলো না। জোরেশোরে শ্বাস ফেলে অনুত্তেজিত চিত্তে আলিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো, “তুমি যাও!”
“ওকে ম্যাম!” কথাটা বলে আলিয়া চলে যেতেই তাজওয়ার মাথা দুলিয়ে বলে উঠলো।

“হুম বস! আপনি ঠিক বলেছেন। আমিও কারও গোলাম নই। আপনার কথাও শুনতে বাধ্য নই। আমি গেলাম। বা…ই!”
কথাটা বলে তাজওয়ার সামনে আগাতেই মেহরিন ওর পথ আগলে দাড়ালো। কথা আর না বাড়িয়ে ফাইলটা উঁচু করে দেখিয়ে বললো, “এসব কি?”
“কোন সব?” না জানার ভান করে মাথা এদিক ওদিক দোলাতে দোলাতে কথাটা বললো তাজওয়ার। যেন এসব সবই অহেতুক বিষয়। মেহরিন নিজের ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করার বৃথা চেষ্টা করতে লাগলো। ক্ষণেই দাঁতে দাঁত চেপে বললো।

“কাজ করার ইচ্ছা না থাকলে করো না, বেড়িয়ে যাও অফিসে থেকে তবুও সময় নষ্ট করো না। নিজে তো কিছু করোই না অন্যকেও করতে দিবে না?”
তাজওয়ার হালকা হাসলো। ক্ষণেই দু পা সামনে এগিয়ে মেহরিনের কানের কাছে ফিসফিস করে বললো।

“আমি তো বেড়িয়েই যেতে চাই কিন্তু বাবার জন্যই তো পারি না। কাজ না করলে একটা টাকাও দিবে না। হয়তো এখানে নয়তো বিজনেস দেখাশোনা করা, দুটোর একটা করতেই হবে বলে দিয়েছে। বিসনেসে অনেক প্যারা, এখানে কম আছে। সো এটাতেই পরে আছি। আমার টাকা দরকার বস! আপনি টাকা দিলে আমি কাজ করবো না। আর হ্যাঁ আমি কাউকে ধরে রাখি নি যে তারা কাজ করতে পারছে না।”
কথাগুলো শুনে মেহরিন কিছুটা সরে গেলো। অতি রূষ্ট কন্ঠে শুধালো, “কাজ না করলে একটা টাকাও পাবে না।”

“জানি। সেজন্যই তো আছি। আমার বাবা আমাক কর্মচারি বানিয়ে দিলো? আপনাকে আমার বস বানালো? চাইলে ওই পদে আমাকে বসাতে পারতো। ইচ্ছাকৃত ভাবে ঠান্ডা মাথায় অপমান করলো। এর বদলা তো নিতেই হবে।”

“যার যোগ্যতা যেমন সে সেখানেই থাকবে। তোমার ফালতু কথা শোনার টাইম নেই, আমার কাজ আছে। ফাইলটা ধরো। ঠিক করে দাও এক্ষুণি।”

ফাইলটা তাজওয়ারের হাতে দিয়ে সামনে আগাতেই বলে উঠলো।
“কেনো ঠিক করবো? ফাইল তো ঠিকই আছে। যেমন ঠিক মনে হয়েছে তেমন করেছি। আপনার পছন্দ না হলে তা কি আমার দোষ? ভালো না লাগলে নিজে ঠিক করে নিন বস।”
ভাব নিয়ে কথাটা বললো তাজওয়ার। মেহরিন বিরক্তি নিয়ে সামনে তাকালো। এই ছেলেটা নিজেও কাজ করবে না অন্যকেউ করতে দিবে না, সবাইকে জ্বালিয়ে ছাড়বে। মেহরিন ওর দিকে এগিয়ে এসে ঠোঁট প্রসারিত করে বললো।

“ওহ রিয়েলি? এক মাইল দূর থেকে দেখলেও বোঝা যায় তুমি এটা ইচ্ছা করে করেছো। আবার তোমার চোখ দেখেও বোঝা যাচ্ছে তুমি মিথ্যা বলেছো। আমি তোমার মতো বোকা নই তাজওয়ার শেখ! কাজ তো পারোই না আবার মিথ্যা কথাটাও ঠিকঠাক মতো বলতে শিখলে না। কি শিখলে জীবনে?

তাজওয়ারের হাসি মুখটা চুপসে গেলো। ও আমতা আমতা করে জো’রপূর্বক হাসলো। মেহরিন কিছু না বলেই রে গে চলে গেলো। তাজওয়ার ফাইলটার দিকে বিরক্তি নিয়ে তাকালো অগত্যা টেবিলের উপর রেখে ফেলে চেয়ারে হেলান দিয়ে নিঃচিন্তায় দোলতে লাগলো। এসব কাজ টাজ ওর ভালো লাগেনা। ও কিছুক্ষণ বসে থেকে বাইরে চলে গেলো।

মেহরিন একজন উচ্চপদস্থ সী আই ডি অফিসার। ২৮ বছরের মেয়েটা পুরো শহরে নাম করে ফেলেছে। ওর সততা আর পরিশ্রমের জন্য ৩ বছরের ক্যরিয়ারে অনেকে সুনাম ও সাফল্য অর্জন করেছে। সততা আর পরিশ্রম সাফল্যের চাবিকাঠি। কেউ সততার সাথে পরিশ্রম করলে তাকে সাফল্যের পিছে ছুটতে হবে না, উল্টো সাফল্য তার পিছে ছুটবে। মানুষ চেষ্টা করলে সবই পারে তবে ভাগ্যও নিজের দিকে হওয়া লাগে। ভাগ্য নিজের পক্ষ্যে না থাকলে যত কাজই করুক সাফল্য আসবে না। যে মেয়েটা একসময় খেতে পায়নি সেই মেয়ের আন্ডারে আজ কাজ করে কত মানুষ। ভাবা যায়?

টেবিলের কর্ণারে থাকা এলবামের দিকে নজর পড়তেই মেহরিনের চোখেমুখ বিষন্নতায় ছেয়ে গেলো। ফটোতে চারটা হাস্যোজ্জ্বল মুখ ভাসছে। তারা কতই না সুখী ছিলো! মেহরিন হতাশ নিশ্বাস ফেললো। ক্ষণেই পাশে আরেকটা ছবির দিকে তাকাতেই ওর বিষন্ন মুখে কিঞ্চিৎ হাসি ফুটলো। ওর ভাবনার মাঝেই তুরফা এসে বললো, “ম্যাম! তাজওয়ার স্যার কেবিনে নেই। চলে গেছে।”
“আজও নাই?”

“না ম্যাম! কে জানে প্রায়দিন এই টাইমে কই যায়? কিছু তো আছেই!”
মেহরিনের চেহারায় ফের রা’গ ফুটে উঠলো। রা’গে চোখমুখ লাল হয়ে এলো। ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বলে উঠলো, “নাহ! আর সহ্য করা যাচ্ছেনা, এক্ষুণি স্যার কে কল করো! ওর আর অফিসে আসতে হবে না।”

তুরফা কল করে মেহরিনকে দিলো। মেহরিন কিছু সময় মি. সাইফুর শেখের সাথে কথা বললো। কলটা কাটতেই সাথে সাথে আরেকটা কল এলো। তুরফা কল ধরতেই ওর মুখটা মলিন হয়ে গেলো। মেহরিন তাড়াতাড়ি করে ফোনটা নিলো।
কানের কাছে ধরতেই মেহরিনের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। অক্ষিকোটর পরিপূর্ণ হলো অশ্রুকণায়। অজানা শঙ্কায় বুক কাঁপছে, মুখ থেকে অস্ফুট স্বরে বেড়িয়ে এলো, “মেহু….”

Leave a comment